আসসালামুয়ালাইকুম। ক্যাম্পাস প্রতিদিন এর নিয়মিত ভিজিটরদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে শুরু করছি আজকের আয়োজন। আজকে আমরা ‘নামাজের নিয়ম কানুন’ সম্পর্কে জানবো ও জানাবো ইনশাআল্লাহ্।
তো চলুন ‘নামাজের নিয়ম কানুন‘ সম্পর্কে আলোচনা শুরু করা যাক।
Table of Contents
নামাজ
নামাজ বা নামায (ফার্সি: نماز) বা সালাত বা সালাহ (আরবি: صلاة) ইসলাম ধর্মের একটি দৈনিক নিয়মিত ইবাদত। নামাজ (সালাত) ইসলামের পাঁচটি রোকনের মধ্যে দ্বিতীয় রোকন৷ নামাজ প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক ও বুদ্ধি-জ্ঞান সম্পন্ন, নারী পুরুষ নির্বিশেষে, প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরজ বা অবশ্যকরণীয়। সালাত একটি সুনির্দিষ্ট প্রকৃতির ইবাদত যার পদ্ধতি ‘ইসলামী শরী‘আতে পরিপূর্ণভাবে বর্ণিত হয়েছে। নামাজ ‘তাকবিরে তাহরিমা’ দ্বারা শুরু হয় ও ‘সালাম ফিরানো’ দ্বারা শেষ হয়’।প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই ফরজ।
নামাজের নিয়ম ও সূরা
নামাজের প্রধান ধাপগুলোকে ‘রাকাত’ বলা হয়। নামাজ দুই বা তিন বা চার রাকাত হতে পারে। ইসলামের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে নামাজ পড়ার রীতিতে কিছু পার্থক্য রয়েছেঃ শিয়া ও সুন্নি পার্থক্য পাশাপাশি সুন্নিদের মধ্যে মাজহাবী পার্থক্য ও লা মাজহাবী তথা আহলে হাদীস বা সালাফী পার্থক্য।
| আরও পড়ুনঃ তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, নিয়ত, ফজিলত |
সুন্নি হানাফি নিয়মঃ
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলিমই হানাফি মাজহাবের অনুসারী। তাই হানাফি মাজহাব অনুসারেই নিচে নামাজ পড়ার সংক্ষিপ্ত নিয়ম উল্লেখ করা হলো। এখানে উল্লেখ্য, চার ইমামের যে কারো তরিকা গ্রহণ করলেও সমস্যা নেই।
- প্রথমে ওজু সহকারে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
- নামাজের নিয়ত করে উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠাতে হবে।
- এরপরে তাকবিরে তাহরিমা পড়ার পর বাম হাতের ওপর ডান হাত রেখে নাভির নিচে হাত বাঁধতে হবে।
- এরপর অনুচ্চৈঃস্বরে পড়তে হবে –‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়াবি হামদিকা ওয়া তাবারা কাসমুকা ওয়া তাআলা জাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।
- এরপর অনুচ্চৈঃস্বরে আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ুন। (তাহাবি : ১/৩৪৭)
- এবার সূরা ফাতিহা পড়তে হবে।
- সূরা ফাতিহা শেষ হলে আমিন বলতে হবে। হানাফি মাজহাব মতে, আমিন আস্তে পড়া উত্তম। তবে জোরে আমিন বলার ব্যাপারেও ইমামদের মতামত পাওয়া যায়।
- সূরা ফাতিহা পড়া শেষ হলে একটি সূরা অথবা তিনটি ছোট আয়াত, যা কমপক্ষে লম্বা একটি আয়াতের সমতুল্য হয়, তাই পড়তে হবে। (আবু দাউদ, হাদিস নং : ৬৯৫)
- অতঃপর আল্লাহু আকবার বলে রুকুতে যেতে হবে। রুকুতে মাথা নিতম্বের বরাবর করতে হবে। (আবু দাউদ, হাদিস নং : ৭২৯)
- রুকুতে আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে হাঁটু আঁকড়ে ধরতে হবে। (মুজামে সাগির ২/৪৯৭)
- রুকুতে তিনবার, পাঁচবার বা সাতবার; কমপক্ষে তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ পড়তে হবে। (তিরমিজি, হাদিস নং : ২৪২)
- এবার রুকু থেকে ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলে মাথা উঠান। মুক্তাদি হলে অনুচ্চৈঃস্বরে শুধু ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ বলতে হবে। এরপর তাকবির পড়ে অর্থাৎ আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যেতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৭৪৭)
- সিজদায় যাওয়ার সময় প্রথমে হাঁটু, তারপর হাত, তারপর উভয় হাতের মধ্যে প্রথমে নাক এবং পরে কপাল মাটিতে রাখতে হবে। নিজের পেট রান থেকে এবং বাহুকে পার্শ্বদেশ থেকে পৃথক করে রাখুন। হাত ও পায়ের আঙুলকে কিবলামুখী করে রাখতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৭৮৫)
- সিজদায় তিনবার, পাঁচবার বা সাতবার; কমপক্ষে তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ পড়তে হবে। (তিরমিজি, হাদিস নং : ২৪২)
- এরপর সিজদা থেকে উঠার সময় সর্বপ্রথম মাথা উঠিয়ে উভয় হাত রানের ওপর রেখে স্থিরতার সঙ্গে বসে পড়তে হবে।
- এরপর তাকবির বলে দ্বিতীয় সিজদা করতে হবে। দ্বিতীয় সিজদায়ও এরপর কমপক্ষে তিনবার তাসবিহ পড়তে হবে। বিজোড় সংখ্যায় এর বেশিও তাসবিহ পড়া যাবে। এরপর জমিনে হাত দ্বারা ঠেক না দিয়ে এবং না বসে সরাসরি তাকবির বলে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। এ পর্যন্ত আমাদের প্রথম রাকাত সম্পন্ন হয়েছে।
- আগের মতো সূরা ফাতিহা ও এর সাথে অন্য একটি সূরা পড়ে রুকু-সিজদা করতে হবে। দ্বিতীয় সিজদা শেষ করে ডান পা খাড়া করে বাম পা জায়নামাজে বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর বসে যেতে হবে। তখন হাত রাখতে হবে রানের ওপর এবং ডান পায়ের আঙুলগুলো থাকবে কিবলামুখী। (মুসলিম, হাদিস নং : ৯১২)
- অতঃপর তাশাহুদ, দরুদ শরীফা, দোয়া মাসুরা পড়তে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৭৮৮)
- অতঃপর ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলতে বলতে ডানে এবং বাঁয়ে মাথা ফেরাতে হবে। সালাম ফেরানোর সময় পাশের নামাজি ব্যক্তি এবং ফেরেশতাদের কথা স্মরণ করবেন।
| আরও পড়ুনঃ মহিলাদের তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম, নিয়ত, ফজিলত |
৫ ওয়াক্ত নামাজ ও নামাজ পড়ার নিয়ম
ফজর নামাজের নিয়ম
ফজরের নামাজ ( صلاة الفجر) অবশ্য পালনীয় দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের দিনের শুরুর নামাজ। ফজরের নামাজ আদায় করেই মুসলিমরা তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম শুরু করেন।
ফজর নামাজ কত রাকাত?
ফজরের নামাজ দুই রাকাত সুন্নত ও দুই রাকাত ফরজ নামাজ নিয়ে গঠিত। আপনারা নামাজের নিয়মাবলি থেকে দুই রাকাআত নামাজের জন্য নামাজের নিয়ম ও প্রয়োজনীয় দোয়া দেখে নিতে পারেন।
ফজর নামাজের শেষ সময়ঃ
সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত ফজরের নামাজের সময়। অর্থাৎ ফজরের নামাজ খুব দ্রুত পড়ে ফেলতে হয়।
যোহরের নামাজের নিয়ম
যোহরের নামাজ বা সালাতুল যুহর (صلاة الظهر)
দৈনিক নামাজগুলোর দিক থেকে এটি দ্বিতীয়। এটি ঠিক দুপুর থেকে আসরের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা হয়।
যোহরের নামাজ কত রাকাত?
যোহরের নামাজ প্রথমে চার রাকাত সুন্নত, চার রাকাত ফরজ ও এরপর দুই রাকাত সুন্নত নিয়ে গঠিত। নামাজি ব্যক্তি যদি মুসাফির অবস্থায় থাকে তাহলে সে চার রাকাত ফরজকে সংক্ষিপ্ত করে দুই রাকাত করতে পারে ও সুন্নত আদায় না করতে পারে।
যোহরের নামাজের শেষ সময়ঃ
শুক্রবার যোহরের পরিবর্তে জুম্মার নামাজ আদায় করা হয়। জুম্মা ও যোহরের সময় শুরু ও শেষ হওয়ার সময়সীমা একইরকম।
আসরের নামাজের নিয়ম
আসরের নামাজ (صلاة العصر) দৈনিক নামাজের ক্রমের দিক দিয়ে এটি তৃতীয়। এটি বিকেলের সময় আদায় করা হয়
আসরের নামাজ কত রাকাত?
আসরের নামাজ চার রাকাত সুন্নত ও চার রাকাত ফরজ নিয়ে গঠিত। তবে ব্যক্তি মুসাফির অবস্থায় থাকলে চার রাকাত ফরজকে সংক্ষিপ্ত করে দুই রাকাত করে কসর আদায় করতে পারবেন।
মাগরিবের নামাজের নিয়ম
মাগরিবের নামাজ (صلاة المغرب) দৈনিক নামাজগুলোর ক্রমের মধ্যে চতুর্থ।
মাগরিবের নামাজ কত রাকাত?
মাগরিবের নামাজ তিন রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নত নিয়ে গঠিত। ফরজ অংশ সাধারণত ইমামের নেতৃত্বে জামাতের সাথে আদায় করা হয় আবার একা ও আদায় করা যায়। তবে ব্যক্তি যদি মুসাফির অবস্থায় থাকে তাহলে শুধু তিন রাকাত ফরজ আদায় করতে পারে কসর হিসেবে।
মাগরিবের নামাজের শেষ সময়ঃ
এটি সূর্যাস্তের পর থেকে গোধূলি পর্যন্ত আদায় করা যায়। এটিও দ্রুততম সময়ে পড়ে ফেলা উত্তম।
এশার নামাজের নিয়ম
এশার নামাজ (صلاة العشاء) দৈনিক নামাজগুলোর মধ্যে এটি পঞ্চম। এটি রাতের সময় আদায় করা হয়।
এশার নামাজ কত রাকাত?
এশার নামাজের ফরজ চার রাকাত। এরপর দুই রাকাত সুন্নত ও তিন রাকাত বিতর নামাজ রয়েছে। ফরজ নামাজের পূর্বে ৪ রাকাত সুন্নত নামাজ পড়া হয়। তবে এটি না পড়লে কোনো গুনাহ হবে না। ব্যক্তি মুসাফির অবস্থায় থাকলে চার রাকাত ফরজকে সংক্ষিপ্ত করে দুই রাকাত করতে পারেন কসর হিসেবে।
এশার নামাজের শেষ সময়ঃ
এশার নামাজে রাতের সময় আদায় করা হয়। গোধূলি থেকে অর্ধ রাত পর্যন্ত এশার নামাজ আদায় করা যায়।
| আরও পড়ুনঃ সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম ও ফজিলত |
নামাজের দোয়া
ছানা দোয়াঃ
‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়াবি হামদিকা ওয়া তাবারা কাসমুকা ওয়া তাআলা জাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।’
ছানা বাংলা অর্থ সহঃ
অর্থ : হে আল্লাহ! আমরা তোমারই পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি, তোমার নামই বরকতপূর্ণ এবং তোমার গৌরবই সর্বোচ্চ, তুমি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। (নাসায়ি, হাদিস নং : ৮৮৯)
সূরা ফাতিহাঃ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আলহামদুলিল্লা-হি রাব্বিল আ-লামীন
আর রাহমা-নির রাহীম
মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন
ইয়্যা-কা না’বুদু ওয়া ইয়্যা-কানাছতা’ঈন
ইহদিনাসসিরা-তাল মুছতাকীম
সিরা-তাল্লাযীনা আন’আম তা’আলাইহিম
গাইরিল মাগদূ বি’আলাইহীম ওয়ালাদ্দাল্লীন।
সূরা ফাতিহা বাংলা অর্থঃ
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে। সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে। অনন্ত দয়াময়, অতীব দয়ালু। প্রতিফল দিবসের মালিক। আমরা শুধু আপনারই দাসত্ব করি এবং শুধু আপনারই নিকট সাহায্য কামনা করি। আমাদের সরল পথনির্দেশ দান করুন। তাদের পথে, যাদের আপনি অনুগ্রহ করেছেন। এবং তাদের পথে নয় যারা আপনার ক্রোধের শিকার ও পথভ্রষ্ট।
তাশাহুদঃ
‘আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতু ওয়াত তায়্যিবাত। আসসালামু আলাইকা, আইয়্যু হান্নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। আস সালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহিন। আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ।’
তাশাহুদ এর অর্থঃ সকল তাযীম ও সম্মান আল্লাহর জন্য, সকল সালাত আল্লাহর জন্য এবং সকল ভাল কথা ও কর্মও আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপানার প্রতি শান্তি, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত বর্ষিত হোক।
দরুদ শরীফঃ
‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলি মুহাম্মদ, কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিম, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলি মুহাম্মদ, কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিম, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।’
দরুদ শরীফ বাংলা অর্থঃ “হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাললাম) এবং তাঁহার বংশধরগণের উপর ঐরূপ রহমত/প্রশংসা অবতীর্ণ কর যেইরূপ রহমত/প্রশংসা হযরত ইব্রাহিম এবং তাঁহার বংশধরগণের উপর অবতীর্ণ করিয়াছ। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসা ভাজন এবং মহামহিম। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাললাম) এবং তাঁহার বংশধরগণের উপর সেইরূপ অনুগ্রহ কর যে রূপ অনুগ্রহ ইব্রাহীম এবং তাঁহার বংশরগণের উপর করিয়াছ। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসা ভাজন এবং মহামহিম।”
দোয়া মাসুরাঃ
‘আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসি জুলমান কাসিরাও ওলা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা, ফাগফিরলি মাগফিরাতাম-মিন ইনদিকা, ওয়ার হামনি ইন্নাকা আনতাল গাফুরুর রাহিম।’
দোয়া মাসুরা বাংলা উচ্চারণ ও অর্থঃ হে আল্লাহ্! আমি আমার নিজ আত্মার উপর বড়ই অত্যাচার করেছি, গুনাহ মাফকারী একমাত্র আপনিই; অতএব আপনি আপনা হতেই আমাকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি দয়া করুন। নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল দয়ালু।
মহান আল্লাহ তালা আমাদের সকলকে সহীহ-শুদ্ধু ভাবে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন
